২০০৭ সালের ৭ মে, ইনকিলাব পত্রিকা থেকে ঃ

দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্তরা। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের অভাব, আয় বৈষম্য আর মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার বিপর্যস্ত করছে জীবনযাপনের ক্ষমতাকে। মমিনুল হক আজাদ ঃ ‘‘বাংলাদেশে জিনিষের দাম ওঠানামা এতই বেশি যে এটা আমাদের অর্থনীতির অস্থায়িত্বের একটি চিহ্ন। কাজের সুযোগের অভাব ও সঞ্চয়ের অভাব একজন মধ্যবিত্তকে অতিসহজে দরিদ্র বানাইতে পারে, তখন তাহার পক্ষে আবার মধ্যবিত্ত হওয়া খুবই কঠিন। ইহাই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র।’’ এ আশঙ্কা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে কথাটি বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর সাবেক পরিচালক এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য অর্থনীতিবিদ আবদুল্লাহ ফারুক। উচ্চবিত্ত এবং দরিদ্র্যের মাঝামাঝি এ মধ্যবিত্ত সত্ত¡াটি দেশীয় ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে অবদান রাখলেও এ শ্রেণীর মানুষের জীবন এখন সত্যিই বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয়, কর্মসংস্থানের অভাব আর আয় বৈষম্যের রূঢ় বাস্তবতায় তাল মেলানো সম্ভব হচ্ছে না মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার খেয়ে ফেলছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। কমে যাচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতাও। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে, অসংখ্য নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার দরিদ্র পরিবারে পরিণত হচ্ছে। বাস্তবতার পরিহাসে অনেকে প্রান্তিক দরিদ্র পর্যায়েও চলে গেছে। চলছে মধ্যবিত্তের ভয়াবহ ক্রান্তিকাল। হারিয়ে যাচ্ছে এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ফলে দেশের সমাজ, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে এ শ্রেণী নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে আর অবদান রাখতে পারছে না।
মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্রে পরিণতঃ গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবার দরিদ্র পরিবারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। ০৬-০৫-২০০৭ তারিখ তিনি ইনকিলাবকে জানান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি। আর এখন সংবিধানের ২য় অনুচ্ছেদের ১৫নং ধারা অনুসারে প্রায় ১০ কোটি মানুষ দরিদ্র। এ বর্ধিত দরিদ্র কোথেকে এলো? উত্তর হচ্ছে-অসংখ্য মধ্য মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে। আর নিম্নমধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ দরিদ্র হয়েছে। তবে মধ্যবিত্ত থেকে সামান্য একটি অংশ উচ্চবিত্তে পরিণত হয়েছে।
জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয়ঃ কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসাব মতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩০.৯৮ শতাংশ। এর আগেও ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১৭৭ ভাগ। ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ২৪৯ শতাংশ। এরমধ্যে শুধু ২০০৬ সালেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১৩.৫২ ভাগ। আর দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১৫.২২ শতাংশ। দ্রব্যমূল্য তথা সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। জীবনযাত্রার এ বর্ধিত ব্যয়ের চাপে মধ্যবিত্তরা ক্রমেই ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে পরিণত হচ্ছে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র। চলতি ২০০৭ সালেও দ্রব্যমূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ে লাগামহীন উর্ধ্বগতি চলছে। কেজি প্রতি ২২-২৪ টাকার নিচে কোন চাল পাওয়া যাচ্ছে না এখন বাজারে। মূল্যস্ফীতি হার প্রায় পৌঁছেছে ৮ শতাংশের কাছাকাছি। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয় স্বাস্থ্য-শিক্ষাখাতেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মঈনুল ইসলামের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের ফি ছিল গড়ে ৫০/-টাকা। এটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে গড়পড়তা ১৫০/-টাকায়। প্রতি পরিবার পিছু এখন স্বাস্থ্যসেবা নিতে বার্ষিক ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪,৮০০/-টাকা থেকে ৭,২০০/-টাকায়। অন্যদিকে শিক্ষা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শুধু দরিদ্র নয় মধ্যবিত্ত পরিবারের অসংখ্য সন্তানকেও উচ্চশিক্ষার স্তরে যেতে যেতে ঝড়ে পড়তে হচ্ছে।
প্রকৃত আয় বাড়েনি ঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৬ অনুসারে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে শহরাঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু মাসিক আয় বেড়েছে ২৪৫/-টাকা। অথচ মাথাপিছু মাসিক ব্যয় বেড়েছে ৩৪২/-টাকা। একই সময়ে পল্লী অঞ্চলে মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র ৫৮/-টাকা। কিন্তু সাথে সাথে মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ৫০/-টাকা। সরকারী হিসেবে মাথাপিছু আয়ের হিসাব প্রতিবছর বাড়লেও প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এটি। যদিও ২০০৪-এর পর বিবিএস-এ ধরণের আর কোন হিসাব করেনি। কিন্তু ওই পরিসংখ্যানে বিষয়টি পরিস্কার যে, বর্তমানে ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু আয় সে তুলনায় বাড়ছে না। তাই প্রকৃত আবাড়ছে না। এর ফলে মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৃত আয় না বাড়ায় মধ্যবিত্তের মধ্যে সঞ্চয়ের হারও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
আয় বৈষম্য বেড়েছে ঃ গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলশ্রুতিতে কিছু পুরাতন ও নব্য ধনিক শ্রেণীর হাতে অর্থ পুঞ্জিভূত হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অধ্যাপক বারকাতের মতে, দেশের মাত্র ২০-৩০ লাখ উচ্চবিত্তের হাতে সম্পদের বেশীরভাগ জমা। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, বন্টন ব্যবস্থার বৈষম্যের কারণে দরিদ্র হচ্ছে আরো দরিদ্র। ধনীরা আরো ধনী। ১৯৯১-৯৫ সাল পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের সাথে সবচেয়ে গরীব ৫ শতাংশ পরিবারের আয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১৮ গুণ। ১৯৯৫-৯৬ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭ গুণ, ২০০০ সালে তা হয় ৪৬ গুণ এবং ২০০৪ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় এটা বেড়ে হয়েছে ৮৪ গুণ।
সঞ্চয় নেই ঃ জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয় ও সে অনুসারে প্রকৃত ব্যয় না বাড়ায় এবং নিজস্ব উৎপাদন কমে যাওয়ায় মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়ার বিরুপ প্রভাব পড়ছে সার্বিক জীবনমানে। আর যাদের জীবনমান নিম্নগামী হচ্ছে, তাদের বড় অংশই সচ্ছল অবস্থায় ফিরতে পারছে না।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘটছে বিপরীত ঃ বাংলাদেশে যখন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনসহ জীবনযাত্রার সার্বিক দুর্বিপাকে হারিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজ, তখন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘটছে বিপরীত। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে মধ্যবিত্ত সমাজ দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে আশা জাগানিয়া ভূমিকা রাখছে। শিল্প স্থাপন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র, মুম্বাই, চেন্নাই, উত্তর প্রদেশে মাঝারি আকারের পুঁজির বিকাশ ঘটছে। বিশেষ করে দ্রুত বিকাশমান আইসিটি খাত ওই এলাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীই পরিচালনা করছে। শ্রীলঙ্কায়ও ভূমিকা রাখছে মধ্যবিত্ত সমাজ। যদিও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে সেটা এখন কিছুটা স্থিমিত। চীন, তাইওয়ানও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাত ধরে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অতীত ঃ ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি (১৮৫০ সালের পর থেকে) পর্যায়ে। শিল্পস্থাপন, পাটসহ অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষার বিস্তার, জনসচেতনতা সৃষ্টি, অফিস আদালত স্থাপন ইত্যাদি নানা কারণে সেসময় থেকে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটতে থাকে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলো পালন করেছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, উৎপাদন-শিল্প বিনির্মাণ, আন্দোলন-রাজনীতিসহ সমাজের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। বিভিন্ন সময়ে সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এমনকি ১৯৯০-এর গণআন্দোলনেও ছিল এ শ্রেণীর সর্বোচ্চ ভূমিকা। মধ্যবিত্তের সা¤প্রতিক অবস্থা নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, মধ্যবিত্ত থেকে একটা বড় অংশ দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। মধ্যবিত্তদের অনেকেই এখন আর টিকে থাকতে পারছে না। তাদের জন্য টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য ছাড়াও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। সরকারী চাকরিজীবিসহ যারা মধ্যবিত্ত হিসেবে পরিচিত তাদের আয় তো বাড়ছে না। এটা আমাদের জন্য অর্থনৈতিক একটা চ্যালেঞ্জ। তবে একটা নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি, ইনকিলাব পত্রিকায় ২০০৬-২০০৭ জাতীয় বাজেটের ওপর এক আলোচনা সভায় বক্তাগণ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোটামোটি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও এ প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পাচ্ছে না। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। বক্তাগণ বলেন, দেশের ৫ শতাংশ ধনীর সাথে দরিদ্রের আয়ের ব্যবধান ১৯৯০ সালে ছিল ১৮ গুণ তা থেকে বেড়ে ২০০৪ সালে এসে দঁড়িয়েছে ৮৪ গুণ। বর্তমান কর কাঠামো বহাল থাকলে এ ব্যবধান আরও বাড়বে।
২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর, প্রথম আলো ঃ সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যবিত্ত-বিআইডিএসের গবেষণা। ২০১৫ সালে এসে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ২২ শতাংশ হবে। যাঁরা দৈনিক দুই থেকে তিন ডলার (পিপিপি হিসাবে) আয় করেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ হিসাবটি স্বীকৃত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *